কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তের দাবি দিলীপের, স্বাস্থ্য ভবনে আচমকা হাজির শুভেন্দু
বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
শনিবার ভোরে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন তৃণমূল সাংসদ–অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী। আর সেই ঘটনায় রীতিমতো হইচই পড়ে যায় গোটা বাংলায়। বৃহস্পতিবারই তিনি কোভিড ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন কসবার সেই ভুয়ো ক্যাম্প থেকে। সেই কারণেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন কিনা, তা নিয়ে অনেকের মনেই আতঙ্ক দেখা দেয়। এদিকে, ওই কাণ্ডে ধৃত দেবাঞ্জন দেবের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ–সহ নানা ধারায় মামলা করেছে রাজ্য সরকার। যদিও বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
শুক্রবার রাত থেকেই দুর্বল ছিলেন মিমি। শনিবার ভোর ৩টে নাগাদ হঠাৎই অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন তিনি। ঘেমে–নেয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। পরিচারিকা তখন তাঁর সহকারীকে ফোন করলে তিনি ছুটে আসেন। খবর দেন চিকিৎসককে। চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করে জানান, ভ্যাকসিনের সাইড এফেক্টের কারণেও এমন অসুস্থতা হতে পারে, আবার অতিরিক্ত চিন্তার প্যানিক কারণেও এই ঘটনা ঘটতে পারে। আপাতত তাঁকে বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। উল্লেখ্য, দিন কয়েক আগে কসবার একটি ভুয়ো ভ্যাকসিন ক্যাম্প থেকেই টিকা নিয়েছিলেন মিমি। কিন্তু তাঁর কাছে ভ্যাকসিনের শংসাপত্র না আসায় বুঝতে পেরে যান তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তার পরই তিনি প্রতারক দেবাঞ্জন দেবের পর্দা ফাঁস করে দেন। তবে ওই ঘটনায় মানসিক ভাবে চাপেও পড়ে যান। সে কথা প্রকাশ্যে জানিয়ে দেন। এর পরই জনসাধারণের উদ্দেশ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় সকলকে সতর্ক থাকার বার্তা দেন তিনি। মিমি জানান, ফরেনসিক বশেষজ্ঞরা তাঁকে জানিয়েছেন, তাঁকে কোভিডের কোনও ভ্যাকসিনই দেওয়া হয়নি।
ঘটনার কথা মিমি প্রকাশ্যে নিয়ে এলে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় রাজ্য জুড়ে। তখনই জানা যায়, ভুয়ো ক্যাম্প চালিয়ে কলকাতা–সহ শহরতলিতে ভুয়ো ভ্যাকসিন দিতেন দেবাঞ্জন দেব। নিজেকে আইএএস অফিসার বলেও পরিচয় দিতেন। কিন্তু তাঁর সেই দাবিও ভুয়ো। শুধু তাই নয়, নিজেকে তিনি কলকাতা পুরসভার জয়েন্ট কমিশনার বলেও পরিচয় দিতেন। বিভিন্ন সভা–সমিতি, অনুষ্ঠানে রাজ্যের মন্ত্রী, পুরসভার কর্তাব্যক্তি এবং শাসক দলের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে তাঁকে দেখা যেত।
কিন্তু তৃণমূল বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিক এদিন একটু ঘুরিয়ে তৃণমূল সাংসদ মিমি চক্রবর্তীর সমালোচনা করায় ভুয়ো ভ্যাকসিন কাণ্ড নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে। এদিন কাঞ্চন বলেন, ‘যে ভাবে জাল টিকা দেওয়া হয়েছে, তা অন্যায়। কিন্তু টিকা নেওয়ার কিছু নিয়ম–নীতি আছে। একজন সচেতন মানুষের উচিত সেইসব নিয়ম মেনে চলা।’ প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কি মিমি চক্রবর্তীরই সমালোচনা করেছেন? তা হলে মিমি ঘটনাটি প্রকাশ্যে নিয়ে এসে কি অন্যায় করেছেন? যদি তাই হয়, তা হলে কি তিনি মিমির কাজেরই সমালোচনা করেছেন? আর লঘু করে দিতে চাইছেন ভুয়ো ভ্যাকসিন কাণ্ডটিকে!
তবে এই কাণ্ড নিয়ে যতই সমালোচনার ঝড় উঠুক না কেন, তাতে কলকাতা পুরসভার নাম জড়িয়ে গেলেও কলকাতা পুরসভার প্রশাসক তথা পরিবহণ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানিয়ে দিয়েছেন, ওই ঘটনা নিয়ে পুরসভা কোনও রকম বিচারবিভাগীয় তদন্ত করবে না। তিনি বলেছেন, ‘দেবাঞ্জন কর্পোরেশনের কেউ নন। বিভাগীয় দুর্নীতিও হয়নি।’ অথচ, ওই ঘটনার আগে সর্বত্র পুরসভার ভুয়ো জয়েন্ট কমিশনার হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেন দেবাঞ্জন দেব। বিভিন্ন সভা–অনুষ্ঠানে রাজ্যের মন্ত্রী, কলকাতার মেয়র, প্রশাসক থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে যোগও দিতেন দেবাঞ্জন। সেইসব সভাগুলিতে দেবাঞ্জনের সঙ্গে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, শান্তনু সেন, অতীন ঘোষ, স্মিতা বকসি, দেবাশিস কুমার–সহ তৃণমূলের অনেক প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রীকে।
যদিও দেবাঞ্জনের কোনও অনুষ্ঠানে যাননি বলে দাবি করেছেন ফিরহাদ হাকিম। বৃহস্পতিবার তালতলায় রবীন্দ্র মূর্তির নামফলকটি পুরসভার তরফে ভেঙে দেওয়া হয়। সেখানে দেবাঞ্জনের পাশাপাশি ফিরহাদ হাকিমেরও নাম ছিল। লেখা ছিল, ফিরহাদ হাকিমই ওই মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেছেন। বৃহস্পতিবারই তিনি দাবি করেন, তিনি নাকি ওই মূর্তির আবরণ উন্মোচনই করেননি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তাই যদি হয়, তা হলে ওই কেলেঙ্কারির পরই কেন নামফলকটি ভেঙে ফেলা হল? কেন আগেই ভাঙা হল না? এ ছাড়া এদিন ফিরহাদ এ কথাও বলেন, ‘আমি দেবাঞ্জনকে চিনতাম না।’
অন্যদিকে, দেবাঞ্জনকে নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে তাঁকে ঝেড়ে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছে শাসক দল তৃণমূল। তারা সব দায় দেবাঞ্জনের ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করতে শুরু করেছেন তৃণমূল নেতা ও নেত্রীরা। সেই তালিকায় রয়েছেন বিধায়ক নয়না দাস, লাভলি মৈত্র, প্রাক্তন সাংসদ শান্তনু সেন প্রমুখ। তবে এই ঘটনার মধ্যে সারদা কেলেঙ্কারির ছায়া দেখতে পাচ্ছেন কেউ কেউ। বিজেপি নেতাদের অনেকেই বলছেন, এ ভাবেই এক সময় সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের বিরুদ্ধে একের পর এক তৃণমূল নেতাদের দিয়ে মামলা করিয়ে তৃণমূল নেত্রী বোঝাতে চেয়েছিলেন, তিনি এবং তাঁর দল কত মহান! ঢেকে দিতে চেয়েছিলেন নিজেদের দোষ।
এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘ঘটনায় পুরসভা জড়িত। পুরসভার সবাই তা জানে। অনুষ্ঠানে পুরসভার লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর গাড়িতে এখানকার সব সরকারি লোগো, পুরসভার লোগো লাগানো রয়েছে। আজ কী করে পুর প্রশাসক বলতে পারেন তাঁকে চিনি না? তিনি প্রত্যেক নেতার সঙ্গে বসেছেন। তাঁদের ফুল দিয়েছেন। লেনদেন সবার সঙ্গেই আছে। এখন ধরা পড়ে গেছেন বলে খারাপ লাগছে, আর চেপে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’ তিনি ওই ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবি করে বলেন, ‘তদন্ত করলে অনেক কিছু বেরোবে। কিন্তু কে তদন্ত করবে? যারা এর সঙ্গে জড়িত তারাই তদন্ত করবে? নিজেরাই ফাউল করবে নিজেরাই রেফারি হবে? সিবিআইকে দিয়ে এর তদন্ত না হলে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে না।’
পাশাপাশি বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী এই ঘটনার জন্য রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, ‘রাজ্য সরকারের প্রধান নেতা ও মন্ত্রীদের ছবি রয়েছে দেবাঞ্জনের সঙ্গে। এখন অস্বীকার করলে হবে? পুরো ঘটনাটার জন্য রাজ্য সরকার এবং শাসক দল দায়ী। এই ঘটনা একটা ভয়ঙ্কর কেলেঙ্কারি।’ এর পরই টুইট করে বলেছেন, ‘২ হাজার কোটির প্যানডেমিক পারচেজ স্ক্যাম কমিটির রিপোর্টও সর্বসমক্ষে আনতে হবে রাজ্য সরকারকে। ওই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন এই রিপোর্ট লুকোনো হচ্ছে? এখনই স্বচ্ছতার সঙ্গে ওই রিপোর্ট প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে হবে।’
এরই মধ্যে ভ্যাকসিন কাণ্ড নিয়ে তিনি চিঠি লিখেছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনকে। ওই চিঠিতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দিয়ে তদন্ত করার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি এদিন কয়েকজন বিজেপি বিধায়ককে নিয়ে শুভেন্দু আচমকাই স্বাস্থ্য ভবনে চলে যান। সেখানে স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে দেখা করেন। ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ভাবে অনুমতি না নিয়ে কেউ যাতে সরকারি দফতরে আসতেন না পারেন, সেই নির্দেশ দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে শুভেন্দু বলেছেন, ‘খবর দিয়ে গেলে তো স্বাস্থ্য সচিব পালিয়ে যেতেন। আর অনুমতি? এই সরকার কোনও কাজে বিরোধীদের অনুমতি দেয়? তাই না জানিয়েই যেতে বাধ্য হয়েছি।’
আবার, ভুয়ো ভ্যাকসিন কাণ্ড নিয়ে বিজেপির অনেক নেতাই এখন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, যদি ওই ঘটনা মিমি চক্রবর্তী প্রকাশ্যে না আনতেন এবং এর ফলে যদি কারও জীবন সংশয় হত, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরো দায় কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে রাজনীতি শুরু করে দিতেন! হয়তো এই ঘটনা কেন্দ্র–বিরোধী একটা বড় ষড়যন্ত্র।